দুর্বৃত্তদের ভেঙে দেয়ার দীর্ঘ ১০ মাস অতিবাহিত হলেও কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রনায়ক বিপ্লবী বীর বাঘা যতীনের সেই ভাস্কর্যটি সংস্কার করা হয়নি। চিঠি চালাচালির মাঝেই আটকে রয়েছে ভাস্কর্যটির সংস্কার কাজ। মুখে ক্ষতচিহ্ন নিয়েই এখন দাঁড়িয়ে আছেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রনায়ক বিপ্লবী বীর বাঘা যতীনের সেই ভাস্কর্যটি।
গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে দুর্বৃত্তরা কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নে কয়া মহাবিদ্যালয়ের সামনে নির্মিত বাঘা যতীনের ভাস্কর্যটি ভেঙে রেখে যায়। হামলায় বাঘা যতীনের ভাস্কর্যটির মুখ ও নাকের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ঘটনার পরদিন কলেজের অধ্যক্ষ হারুন অর রশীদ বাদী হয়ে কুমারখালী থানায় অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের নামে মামলা করেন। মামলা দায়েরের পর গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর কয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আনিসুর রহমানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরবর্তীতে তার দেয়া স্বীকারোক্তি অনুযায়ী আনিসুরের সহযোগী দুই যুবলীগ কর্মী সবুজ হোসেন ও হৃদয় আহমেদকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
আরও পড়ুন: বাঘা যতীন: যার বীরত্বে কেঁপে উঠেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য
পুলিশ জানায়, যুবলীগ সভাপতি আনিসুর রহমানই ভাস্কর্যটি ভাংচুর করার মূল পরিকল্পনাকারী।
কুমারখালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রাকিবুল ইসলাম জানান, গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর আসামিদের আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন জানানো হয়। আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডে তারা পুলিশকে জানায়, কয়া কলেজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধের জের ধরে অন্য নেতাদের ফাঁসাতে তারা চারজন মিলে পরিকল্পিতভাবে বাঘা যতীনের ভাস্কর্যটি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছেন। এ ঘটনার পর আনিসুরকে দল থেকে বহিষ্কার করে কুমারখালী উপজেলা যুবলীগ।
এ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী যুবলীগ নেতা আনিসুর রহমান ও তাঁর দুই সহযোগী বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। ঘটনার পর থেকে এই মামলার অপর আসামি কয়া গ্রামের বাচ্চু শেখ পলাতক রয়েছেন।
আরও পড়ুন: কুষ্টিয়ায় বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভাঙচুর: যুবলীগ নেতাসহ গ্রেপ্তার ৩
এদিকে ভাস্কর্যটি ভাঙচুরের ঘটনার প্রায় দশ মাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও বিল্পবী বীর বাঘা যতীনের সেই ভাস্কর্যটি সংস্কার বা মেরামত করা সম্ভব হয়নি।
এতদিনেও কেন সংস্কার করা হয়নি বাঘা যতীনের ভাস্কর্যটি জানতে চাওয়া হলে কয়া মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হারুন অর রশীদ জানান, ভাস্কর্যটি সংস্কার করার জন্য চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি কলেজ অধ্যক্ষ বরাবর জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে সহকারী কমিশনার রিজু তামান্না স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দেয়া হয়। ওই চিঠিতে দ্রুত ভাস্কর্যটি সংস্কার করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। একই সাথে কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ওই চিঠির অনুলিপি প্রদান করা হয়।
আলোচিত এ ঘটনাটি নিয়ে মামলা আদালতে বিচারাধীন থাকার কারণে আইনি জটিলতা এড়াতে কলেজের পক্ষ থেকে গত ৩ মার্চ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কুমারখালী আদালতের বিচারক সেলিনা খাতুনের আদালতে ভাস্কর্যটি সংস্কারের অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়। আবেদনের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট আদালত গত ৭ মার্চ ভাস্কর্য সংস্কারের অনুমতি প্রদান করেন।
অধ্যক্ষ জানান, আদালতের অনুমতি পেয়ে তিনি ওই দিনই ভাস্কর্যটি সংস্কারের জন্য কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেছেন। কিন্তু পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে মামলার চার্জশীট প্রদান না করা পর্যন্ত ভাস্কর্যটি সংস্কার না করায় জন্য অনুরোধ জানানোর কারণে ভাস্কর্যটি সংস্কার করা সম্ভব হচ্ছে না বলে তিনি দাবি করেন।
তবে অধ্যক্ষের দাবি অস্বীকার করে কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুজ্জামান তালুকদার জানান, পুলিশের পক্ষ থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষকে লিখিত-মৌখিক এ ধরনের কোন নির্দেশনা প্রদান করা হয়নি।
ভাস্কর্য সংস্কারের অগ্রগতি জানতে চাওয়া হলে কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) এসিল্যান্ড তামান্না তাসনিম বলেন, তিনি মাত্র কিছু দিন আগে কুমারখালীতে যোগদান করেছেন। মামলাটি যেহেতু আদালতে বিচারাধীন রয়েছে সে কারণে ভাস্কর্য সংস্কার করা নিয়ে আইনি কোনো জটিলতা আছে কিনা এ বিষয়টি তাঁর জানা নেই।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো.সাইদুল ইসলাম জানান, ভাস্কর্যটি এতদিনেও কেন সংস্কার করা হলো না তা খতিয়ে দেখে যত দ্রুত সম্ভব সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
এদিকে দীর্ঘসময় পার হলেও ভাস্কর্যটি সংস্কার না হওয়ায় জেলার সংস্কৃতিকর্মীরা ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কুষ্টিয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম বলেন, এটি খুব লজ্জা এবং দুঃখজনক ঘটনা। কুষ্টিয়ার কৃতি সন্তান যে বীরের নাম শুনলে এক সময় ব্রিটিশ শাসক পর্যন্ত ভয়ে কাঁপত সেই বীরের ভাস্কর্যটি দুর্বৃত্তদের হামলার ক্ষত নিয়ে এভাবে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকবে এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তিনি অতি দ্রুত ভাস্কর্যটি সংস্কারের দাবি জানান।
উল্লেখ্য ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রনায়ক বিপ্লবী বীর বাঘা যতীনের স্মৃতি ধরে রাখতে কুমারখালী উপজেলা প্রশাসনের অর্থায়নে কয়া মহাবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ২০১৮ সালে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়।